দৈনিক একুশের বাণী | THE DAILY EKUSHER BANI

এলডিসি থেকে উত্তরণ ও ট্রিপস এগ্রিমেন্ট: নতুন যুগের দোরগোড়ায় বাংলাদেশ

মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রপ্তানির ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং সর্বোপরি এলডিসি থেকে উত্তরণের অর্জন—সব মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাসের পথে। কিন্তু এই সাফল্যের পাশাপাশি সামনে এসেছে একগুচ্ছ নতুন চ্যালেঞ্জ। ব্যবসায়িক পরিবেশ, করনীতি, ব্যাংকিং খাত ও সরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবার এখনই সময়। কারণ একদিকে যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে, অন্যদিকে উদ্যোক্তারা পড়ছেন বাস্তবিক নানা বাধা-বিপত্তির মুখে।

NATIONAL NEWS

10/14/20251 min read

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ, ঢাকা : বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক ঐতিহাসিক মোড়ে দাঁড়িয়ে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রপ্তানির ধারাবাহিক অগ্রগতি এবং সর্বোপরি এলডিসি থেকে উত্তরণের অর্জন—সব মিলিয়ে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাসের পথে। কিন্তু এই সাফল্যের পাশাপাশি সামনে এসেছে একগুচ্ছ নতুন চ্যালেঞ্জ। ব্যবসায়িক পরিবেশ, করনীতি, ব্যাংকিং খাত ও সরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবার এখনই সময়। কারণ একদিকে যেমন সম্ভাবনার দুয়ার খুলছে, অন্যদিকে উদ্যোক্তারা পড়ছেন বাস্তবিক নানা বাধা-বিপত্তির মুখে।

ব্যবসায়িক পরিবেশ: সম্ভাবনা বড়, কিন্তু পথ এখনো বন্ধুর
দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ১৭ কোটি মানুষের বিশাল বাজার, সাশ্রয়ী শ্রমশক্তি এবং কৌশলগত অবস্থান আমাদের ব্যবসায়িক খাতকে করেছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। তৈরি পোশাক খাতের সাফল্যের পর ফার্মাসিউটিক্যালস, আইটি, চামড়া, জাহাজ নির্মাণ ও কৃষিপণ্য রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে।

তবে উদ্যোক্তারা বলছেন, “আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, নীতির অস্থিরতা ও অনুমোদনের দুরূহতা” অনেক সময় বিনিয়োগের গতি কমিয়ে দিচ্ছে। একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ও পরিচালনা করতে যে পরিমাণ লাইসেন্স ও কাগজপত্রের প্রয়োজন হয়, তা বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করছে

করব্যবস্থা: প্রবৃদ্ধির সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধক?
বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এখনো দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন—মাত্র ১০ থেকে ১১ শতাংশের মধ্যে। করের হার তুলনামূলক বেশি হলেও করজাল দুর্বল, ফলে প্রকৃত করদাতারাই বারবার চাপে পড়ছেন। বহু সংস্থার কর দাবি, জটিল অডিট প্রক্রিয়া ও অযৌক্তিক নোটিশ অনেক সময় হয়রানির পর্যায়ে পৌঁছে যায়। উদ্যোক্তাদের অভিযোগ—ভ্যাট ব্যবস্থার অসঙ্গতি ব্যবসার উপর বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, বিনিয়োগবান্ধব ও পূর্বানুমেয় করনীতি ছাড়া টেকসই প্রবৃদ্ধি সম্ভব নয়।

ব্যাংকিং খাতে অস্থিরতা: ব্যবসার রক্তস্রোতে বাধা
দেশের ব্যাংকিং খাত বর্তমানে গভীর সংকটে। খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা। সুদের হার নিয়ন্ত্রণ, তারল্য সংকট এবং ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। প্রকৃত উদ্যোক্তারা যেখানে সহজ শর্তে ঋণ পেতে হিমশিম খাচ্ছেন, সেখানে রাজনৈতিক প্রভাবশালী গোষ্ঠী বিপুল ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে যাচ্ছেন অনায়াসে। ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা ব্যবসা সম্প্রসারণে অর্থায়ন পাচ্ছেন না—যা সামগ্রিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করছে।

সরকারি সংস্থার চাপ: উদ্যোক্তাদের জন্য ‘লাল ফিতা’র জাল
বেসরকারি খাত বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় ৮০ শতাংশ অবদান রাখে। কিন্তু উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ—সরকারি সংস্থাগুলোর অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ ও জটিলতা। একটি ব্যবসা পরিচালনায় উদ্যোক্তাদের NBR, BSTI, পরিবেশ অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন, শ্রম দপ্তর সহ অসংখ্য সংস্থার অনুমোদন ও প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। একই বিষয়ে একাধিক সংস্থার ভিন্ন নির্দেশনা ও নীতিমালা পরিবর্তনের অনিশ্চয়তা উদ্যোক্তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ভেঙে দেয়। অর্থনীতিবিদদের মতে, সরকারকে এখনই ‘সহযোগিতামূলক প্রশাসনিক কাঠামো’ গড়ে তুলতে হবে, যাতে উদ্যোক্তারা ভয়ের নয়, আস্থার পরিবেশে ব্যবসা করতে পারেন।

এলডিসি উত্তরণ ও ট্রিপস বাস্তবতা: প্রস্তুত তো আমাদের শিল্পখাত?
বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণ নিঃসন্দেহে গৌরবময় অর্জন। তবে এর পরবর্তী বাস্তবতা হবে আরও প্রতিযোগিতাপূর্ণ। বিশেষ করে ফার্মাসিউটিক্যালস, তৈরি পোশাক ও কৃষি-ভিত্তিক শিল্পখাতের সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। ট্রিপস এগ্রিমেন্টের আওতায় ফার্মাসিউটিক্যাল শিল্পকে পেটেন্ট সুরক্ষা মেনে চলতে হবে, যা উৎপাদন ব্যয় ও বাজার প্রতিযোগিতা উভয়ই বাড়াবে। এছাড়া রপ্তানি খাতে শুল্কমুক্ত সুবিধা হারানোয় নতুন করে বাজার কৌশল নির্ধারণ অপরিহার্য হয়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ আংশিকভাবে প্রস্তুত হলেও গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে আরও বড় বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি।

সম্ভাবনা ধরে রাখতে করণীয়
১. ব্যবসাবান্ধব করনীতি: করের হার কমিয়ে করজাল বিস্তৃত করা, হয়রানি রোধ করা।
২. ব্যাংকিং খাত সংস্কার: খেলাপি ঋণের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা ও প্রকৃত উদ্যোক্তাদের সহজ ঋণ সুবিধা নিশ্চিত করা।
৩. ‘One Stop Service’ কার্যকর করা: উদ্যোক্তাদের জন্য এক জায়গায় সব অনুমোদন সেবা নিশ্চিত করা।
৪. নীতির স্থিতিশীলতা: দীর্ঘমেয়াদি নীতি নির্দেশনা ও পূর্বানুমেয় প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা।
৫. গবেষণা ও উদ্ভাবনে বিনিয়োগ: সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতায় প্রযুক্তি ও উদ্ভাবননির্ভর শিল্প গড়ে তোলা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা মূলত বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মেধা, শ্রম ও সাহসের ফল। কিন্তু যদি ব্যবসায়িক পরিবেশ জটিল হয়, করনীতি হয়রানিমূলক থাকে, ব্যাংকিং খাত অস্থির হয় এবং সরকারি সংস্থাগুলোর চাপ অব্যাহত থাকে—তবে এই অগ্রগতি টেকসই হবে না।

এখন সময় এসেছে সরকার, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারক সকল মহলের যৌথ উদ্যোগে একটি স্থিতিশীল, বিনিয়োগবান্ধব ও সহযোগিতামূলক ব্যবসা পরিবেশ গড়ে তোলার। তাহলেই এলডিসি উত্তরণের পরও বাংলাদেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে পারবে।