দৈনিক একুশের বাণী | THE DAILY EKUSHER BANI

আত্মহত্যা: আমরা কি সত্যিই দায়মুক্ত?

সম্প্রতি আত্মহত্যার প্রবণতা বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। কয়েকদিন আগে আত্মহত্যা করেছেন দেশের এক জেলার স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকের সন্তান। এর কিছুদিন আগেই আত্মহননের পথ বেছে নেন একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। এভাবে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবারের বুক খালি হচ্ছে, সমাজ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় একেকটি প্রাণ।

HEALTH

5/28/20251 min read

ফরিদ উদ্দিন আহমেদ
সম্প্রতি আত্মহত্যার প্রবণতা বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। কয়েকদিন আগে আত্মহত্যা করেছেন দেশের এক জেলার স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদকের সন্তান। এর কিছুদিন আগেই আত্মহননের পথ বেছে নেন একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা। এভাবে প্রতিদিনই কোনো না কোনো পরিবারের বুক খালি হচ্ছে, সমাজ হারাচ্ছে সম্ভাবনাময় একেকটি প্রাণ।

তবে আত্মহত্যা শুধু একটি ব্যক্তিগত ঘটনা নয়, এটি একটি সামাজিক ব্যর্থতা। একজন মানুষ যখন এই পৃথিবী ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন শুধুমাত্র তার নিজের নয়—পরোক্ষভাবে তার আশেপাশের মানুষ, পরিবার, বন্ধু, সহকর্মী—সবার ওপরই পড়ে দায়ের ভার।

আত্মহত্যাকারীর মানসিক অবস্থা: এক অজানা যুদ্ধ
একটি মানুষ যখন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সে একটি ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। হতাশা, অবহেলা, অপমান, বিভিন্ন ধরনের ব্যর্থতা, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আর্থিক অনিশ্চয়তা কিংবা আত্মসম্মান বোধে চরম আঘাত—এইসব কারণেই সে ধীরে ধীরে সমাজ ও জীবনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। বহুক্ষেত্রে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারী তার কষ্ট প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায় না বা কেউ তা শুনতেও চায় না।

তারা অনেক সময়ই সুইসাইডাল নোটে লেখেন—"আমি আর পারছি না", "আমার কথা কেউ বোঝে না", "জীবনটাকে বোঝার কেউ নেই"। প্রশ্ন হলো—এই বোঝার অভাবটা তৈরি হলো কেন? সে কারো জন্য ছিল না? কেউ তার পাশে এসে দাঁড়ায়নি?

আত্মহত্যাকারীর দায়: জীবন নিজে বানায় না, কিন্তু নিজে শেষ করে
ইসলামে আত্মহত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আল-কোরআনে বলা হয়েছে: “তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু।” — (সূরা আন-নিসা: ৪:২৯)

আত্মহত্যা মানে আল্লাহর দেওয়া জীবনের প্রতি অবজ্ঞা করা। এটি কেবল নিজের জীবনের অপচয় নয়, বরং নিজের পরিবার ও সমাজের ওপর একটি অমানবিক আঘাত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) হাদিসে বলেছেন: “যে ব্যক্তি নিজেকে যে যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করে, কেয়ামতের দিন তাকে সেই যন্ত্রণা দিয়েই শাস্তি দেওয়া হবে।” — (সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম)

এ থেকে বোঝা যায়, আত্মহত্যা কোনো “মুক্তির পথ” নয় বরং চিরস্থায়ী এক আযাবের দরজা।

তবে আত্মহত্যাকারী একা দায়ী কি? সমাজের দায় কোথায়?
প্রশ্নটা জটিল, কিন্তু এড়িয়ে যাওয়ার নয়। অনেক আত্মহত্যার পেছনে সরাসরি দায়ী হয়ে থাকে তার নিকটজনদের আচরণ। বাবা-মায়ের অতিরিক্ত প্রত্যাশা, অবহেলা, মানসিক চাপ, শিক্ষক-সহপাঠীর কটাক্ষ, কর্মক্ষেত্রে হেনস্তা কিংবা বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার শিকার অনেক সময় কাউকে ঠেলে দেয় চরম সিদ্ধান্তের দিকে।

আমরা কি কখনো ভাবি, আমাদের একটি কটু কথা, একটি অবহেলা, একটি নির্দয় মন্তব্য কাউকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিতে পারে?

বিবেকের দায়: আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, সহকর্মীদের করণীয়
প্রতিটি মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য একটি অদৃশ্য যুদ্ধক্ষেত্র। আমরা কেউই জানি না, আমাদের পাশের মানুষটি কতটা একা, কষ্টে বা ভেতরে ভেঙে পড়েছে। তাই সহানুভূতি, সহমর্মিতা, শ্রবণশীলতা—এই গুণগুলো চর্চা করা এখন সামাজিক দায়িত্ব।

· বাবা-মায়ের উচিত সন্তানের প্রতি অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ না করে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা।
· শিক্ষক ও সহকর্মীদের উচিত ব্যক্তিগত কটাক্ষ থেকে বিরত থাকা এবং মানসিক সহযোগিতা প্রদান করা।
· বন্ধুবান্ধবদের উচিত খেয়াল রাখা, কোনো বন্ধুর আচরণে অস্বাভাবিকতা দেখলে তার পাশে দাঁড়ানো।
· সমাজের সর্বস্তরে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে তোলা জরুরি।

সমাধান কোথায়?
১. পারিবারিক বন্ধন মজবুত করা – প্রতিটি পরিবার হোক একেকটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
২. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনা – ডিপ্রেশন বা দুঃখ গোপন করার বিষয় নয়।
৩. ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার চর্চা – ইসলামী শিক্ষায় জীবন ও মৃত্যুর অর্থ বুঝলে আত্মহত্যার চিন্তা কমবে।
৪. সাইকোলজিক্যাল কাউন্সেলিং – অবহেলা না করে মানসিক সমস্যায় পেশাদার সাহায্য নেওয়া।
৫. সোশ্যাল মিডিয়ার ইতিবাচক ব্যবহার – কাউকে অপমান নয়, প্রেরণা দেওয়া হোক দায়িত্ব।

উপসংহার: বিবেক জাগাও, জীবন বাঁচাও
আত্মহত্যা একটি মৃত্যু নয়, এটি একটি সমাজের পরাজয়। এই পরাজয় থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত মানবিক প্রয়াস। পরিবার, বন্ধু, সমাজ, রাষ্ট্র—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।

আমরা প্রতিজ্ঞা করতে পারি—আমরা কারো কষ্টকে অবহেলা করব না। পাশে দাঁড়াবো, মনোযোগ দিয়ে শুনবো, সাহস জোগাবো। তবেই হয়তো কেউ আর লিখবে না—“আমি আর পারছি না।” তবেই হয়তো একটি জীবন বাঁচবে, একটি পরিবার ভাঙার হাত থেকে রক্ষা পাবে।